শেখ মুজিব ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়ে রক্ষী বাহিনী বানিয়ে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল—এ কথা আজ অনেক তরুণপ্রজন্মের বাংলাদেশিই জানে না।নৃশংস রক্ষীবাহিনীকে আগাম দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল শেখ মুজিবের তৈরি ইনডেমনিটি আইনে। রক্ষীবাহিনীকে দায়মুক্তি বা ইনডেমনিটি দিয়ে তৈরি করা আইনটিতে বলা হয়েছিল—এই বাহিনী যখন যাকে ইচ্ছা আটক, যে কোন সময় যে কোন জায়গায় তল্লাশি করতে পারবে। এই কাজ করতে গিয়ে তারা যা করবে সবই দায়মুক্ত থাকবে। কোন আদালতে রক্ষ্মিবাহিনীর কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। দায়মুক্তি নিয়েই রক্ষীবাহিনী ৪০ হাজারের বেশি ভিন্নমতের মানুষকে হত্যা করেছিল।
আসুন আবেগ বিসর্জন দিয়ে, সত্যের আলোকে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকালের দিনগুলোকে স্মরণ করি। স্মরণ করি সেদিনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থা কেমন আকার ধারণ করেছিল? মুজিব শাসনের দিনগুলো জনকল্যাণমূলক ছিল কি? দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার কতটুকু নিশ্চিত ছিল? লুটতরাজের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির অবস্থার কি ভয়াবহ পরিণতি হয়েছিল? কোন স্বাভাবিক উপায়ে সরকার বদলের পথ কি খোলা ছিল? এই প্রশ্নগুলো একটু নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে দেখি।
সরকারের চোখের সামনে যুদ্ধোত্তর ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তান আর্মির ফেলে যাওয়া উন্নত মানের সমরাস্ত্র-ট্যাংক, কামান গোলাবারুদ, মিলকারখানার মেশিন পার্টস, বিদেশি গাড়ি, দোকান থেকে স্বর্ণালঙ্কার, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, এমনকি বাথরুম ফিটিং পর্যন্ত খুলে নিয়ে গেল। যার মূল্য কম করে হলেও সেই সময়ের ৫০হাজার কোটি টাকার মত হবে।সরকার নিশ্চুপ! ১৯৭৪ সালের ১২ মে ভারতের অমৃতবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছিল-‘ভারত দুইশ হইতে আড়াইশো ওয়াগন ভর্তি অস্ত্রশস্ত্র বাংলাদেশ সরকারের অনুমতিক্রমে স্থানান্তরিত করেছে’। বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জলিল প্রতিবাদ করায় তাকে কারাবন্দি করা হল। মেজর জলিল আক্ষেপ করে বলেছিলেন ‘আমারই সাধের স্বাধীন বাংলায় আমিই হলাম প্রথম রাজবন্দী’।
শেখ মুজিব, সরকার প্রধান হয়ে দেশটাকে পৈত্রিক লাখেরাজ সম্পত্তির দেশ বানিয়ে ফেলেন। যেখানে যত আত্মীয় স্বজন ছিল-ভাই ,ভাগ্নে, ভগ্নীপতি, ভাতিজা সকলকে টেনে এনে মন্ত্রিত্ব এবং সরকারি পদ পদবী বিলিবন্টন করে দিলেন। ফলে সরকার পরিণত হল একদল অযোগ্য মানুষের আখড়ায়। সরকারের এডমিনিস্ট্রেশন বলতে কিছু থাকল না।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হিসাবে নানান দেশ থেকে ৫০লক্ষ স্টার্লিং পাউন্ড সাহায্য এল। যা দিয়ে দুইটা বাংলাদেশ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে বলে বলা হল। সব লুটপাট হয়ে গেল। রিলিফের খাদ্য সামগ্রী কলকাতার ফুটপাথে বিক্রী হতে দেখা গেল। মুজিব সাহেব বললেন, এতদিন খাইছে অদের লোক, অখন খায় আমার লোক। আত্মীয়স্বজন ও দলের লোকজনদের অবিরাম লুটপাটের ফলে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পড়লো। দেশে ধেয়ে এল ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ।
শেখ মুজিব আমলের সেই ভয়াবহ মহাদুর্ভিক্ষের হৃদয়বিদারক চিত্র, ১৯৪৩ সালে আঁকা শিল্পী জয়নুল আবেদীনের বিখ্যাত দুর্ভিক্ষের চিত্রগুলোর কথাই মনে করিয়ে দেয়। পথে পথে অনাহারক্লিষ্ট মানুষের লাশ ছড়িয়ে আছে। ১০লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল খাবার না পেয়ে। ২লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল পুষ্টিহীনতায়। ১লক্ষ মারা গিয়েছিল বিনাচিকিৎসায়। মানুষের পরনের কাপড় নেই। কাপড়ের অভাবে গ্রামের বাসন্তীরা মাছের জাল জড়িয়ে লজ্জা নিবারনের চেষ্টা করছিল। অর্ধ উলঙ্গ নারীরা লজ্জা ভুলে রাস্তায় নেমে মিছিল করতে বাধ্য হয়েছিল। কাপড়ের অভাবে লজ্জায় মানুষ আত্মহত্যা করেছে। সেই দুর্ভিক্ষ যারা নিজ চোখে না দেখেছে তারা আজ কল্পনা করতে পারবেনা তার ভয়াবহতা। মানুষ বাঁচার জন্য গাছের পাতা চিবিয়ে খেয়েছে , ডাস্টবিন থেকে পচা খাবার কুড়িয়ে খেয়েছে । দেশে যখন খাওয়ার অভাবে শতশত মানুষ মারা যাচ্ছে, তখন মুজিব সাহেবের বাড়ীতে হীরার মুকুট মাথায় পরিয়ে বধূবরণ চলছে। ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টালের ‘সাকী’ বারে চলছে সরকার পোষ্য কালোবাজারি পাচারকারীদের বিদেশি মদের ফোয়ারা উৎসব। আসলে এই দুর্ভিক্ষ এই মহামরণ প্রাকৃতিক ছিলনা, ছিল ম্যানমেড। ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় (৮ই নভেম্বর ১৯৭৪) সংখ্যায় এইস ডি এস গ্রীনওয়ে লিখেছিলেন ‘সারা দেশে ফসল নষ্ট হয়নি। ঘাটতিটুকু অনায়াসে কাটিয়ে ওঠা যেত। কিন্তু সরকারি অক্ষমতা, ব্যাপক দুর্নীতি, ভারতে চাল পাচার প্রভৃতির জন্য তা একটা জাতীয় বিপর্যয়ে পরিণত হয়েছে’।
দেশে আইন শৃঙ্খলা বলতে কিছুই ছিলনা। শ্লোগান দেয়া হত “আইনের শাসন মানিনা, মুজিবের শাসন মানি”। বিদেশী সংবাদপত্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, হাইজ্যাক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে ২২হাজার, চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটে ৬০হাজার, ব্যাংক লুট হওয়ার ঘটনা ঘটে ১৫০টি । আগুন দেয়া হয় ৭২ পাটের গুদামে, দেশ থেকে পাচার হয় ১০হাজার কোটি টাকার মালামাল। সরকারী দলের লোকজন পাকিস্তানিদের বা উর্দু ভাষাভাষীদের বা ভিন্নমতাবলম্বীদের শিল্প প্রতিষ্ঠান দোকান, বাড়িঘর দখল করে প্রায় ১৩ হাজার, জমি দখল করে ৫০হাজার একর। অস্ত্র লুট হল ১৫০০০, ধর্ষনের ঘটনা ঘটে অগণিত।
যে কোন কারণে হোক শেখ মুজিব দেশের সেনাবাহিনীর উপর বিশ্বাস করতেন না । দেশের গৌরবময় সেনাবাহিনীকে উপেক্ষা করে তিনি ভারতীয় বেশভূষায় ভারতীয় ট্রেনিংয়ে রক্ষীবাহিনী নামক নিজস্ব বাহিনী গড়ে তোলেন। সেসময় দেশ রক্ষার সেনাবাহিনী সদস্যদের পোষাকের অভাবে লুঙ্গী পরে কেডস পায়ে প্যারেড করতে দেখা গেছে। অথচ রক্ষীবাহিনীর জন্য উন্নতমানের পোষাক ও অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে। এই রক্ষীবাহিনী প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিল না । রক্ষীবাহিনীর কার্যক্রম পরিচালিত হত সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের দপ্তর থেকে। রক্ষীবাহিনী ছিল এক আতঙ্কের নাম । এরা কাউকে স্পর্শ করলে তার গায়ের চামড়া থাকতোনা। কাউকে গ্রেফতার করলে থানা বা জেলখানায় পাওয়া যেতনা, দু তিনদিন পর খালে বিলে গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যেত। মুজিবের বিরুদ্ধে যারাই কথা বলেছে তাঁদেরই হত্যা করা হয়েছে। সে সময় রক্ষীবাহিনী প্রায় ৪০হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল।
শেখ মুজিব কোন সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না। তার রাজনৈতিক গুরু মওলানা ভাসানীকে গৃহবন্দী করেছিলেন। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ মুক্তিযোদ্ধা শিরাজ শিকদার কে গ্রেফতার অবস্থায় হত্যা করা হয়েছিল। পরে সংসদে দাঁড়িয়ে সদম্ভে শে মুজিবুর রহমান বলেছিলেন (২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫) “কোথায় আজ সেই শিরাজ শিকদার”। এই যুগে জনগণের নির্বাচিত কোন নেতা এ ধরনের উক্তি করতে পারেন কিনা আমার জানা নেই।
শেখ মুজিব তার শাসনতান্ত্রিক ব্যর্থতা চাপা দিতে গিয়ে রক্ষীবাহিনী ছাড়াও লালবাহিনী, শ্রমিক লীগ, ছাত্রলীগ নামের নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী সৃষ্টি করেছিলেন। এসব বাহিনীর নির্যাতন, ধর্ষণ, লুটপাটে কত হাজার পরিবার যে সর্বস্বান্ত হয়েছ সর্বহারা হয়েছে, নির্যাতিত, গুম, পঙ্গু হয়েছে তার পরিসংখ্যান দিতে গেলে কয়েক খণ্ড পুস্তকের প্রয়োজন পড়বে। দেশের ৯৫% মানুষ সেই অপশাসন থেকে নিষ্কৃতি চাইছিল, কিন্তু পথ খুঁজে পাচ্ছিলনা।
শেখ মুজিব ও বুঝতে পারছিলেন তার গ্রহণযোগ্যতা শূন্যের কোটায় নেমে গেছে, এ অবস্থায় ক্ষমতায় বেশিদিন থাকা যাবেনা। তখন তিনি তার ব্যক্তিগত বিশ্বস্ত মানুষের সাথে পরামর্শ করে এমন এক পথ বের করলেন যে পথে কেউ কোনদিন তাকে শাসন ক্ষমতা থেকে সরাবার কথা চিন্তাও করার সুযোগ থাকবে না।মুজিব সেই পথের নাম দিলেন দ্বিতীয় বিপ্লব।
১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী এনে মাত্র কয়েক মিনিট সময়ের মধ্যে এক বিল পাশ করা হয়। দেশের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে গলাটিপে হত্যা করে এক নেতার বাকশাল প্রতিষ্ঠা করা হল এই বিলের মাধ্যমে। এরই নাম দিলেন দ্বিতীয় বিপ্লব । জনগণের দীর্ঘকালের আকাঙ্ক্ষা লালিত গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটল। মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকারের পরিবর্তে চালু হল একক ক্ষমতা সম্পন্ন রাষ্ট্রপতি শাসন পদ্ধতি । দেশের বহুদলীয় রাজনীতি বিলুপ্ত হল, চালু হল একদল বাকশাল পদ্ধতি। সরকারের নিয়ন্ত্রণে মাত্র ৪টি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা রেখে সমস্ত পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হল।
Please support us by visit and share your comments on:http://onlinebdpolitics.com and https://daily-nobojug.com/